Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

ইউআইএসসি

ইউনিয়ন পরিষদ দেশের প্রাচীনতম স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান। এটি তৃনমুল পর্যায়ে জনগণের সবচেয়ে কাছের সরকার। ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপিত তথ্য-প্রযুক্তিভিত্তিক কেন্দ্র 'ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্র (ইউআইএসসি)' পরিষদকে নতুন মাত্রা প্রদান করেছে। ২০১০ সালের ১১ নভেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর কার্যালয় থেকে এবং নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)’র প্রশাসক মিস হেলেন ক্লার্ক ভোলা জেলার চর কুকরিমুকরি ইউনিয়ন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সারাদেশের সকল ইউনিয়ন পরিষদে একটি করে ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্র (ইউআইএসসি) একযোগে উদ্বোধন করেন। ইউআইএসসি’র মূল লক্ষ্য হল, ইউনিয়ন পরিষদকে একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিনত করা, যাতে এই সব প্রতিষ্ঠান ২০২১ সালের মধ্যে একটি তথ্য ও জ্ঞান-ভিত্তিক দেশ প্রতিষ্ঠায় যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারে। পাশাপাশি এই সব কেন্দ্র সরকারি-বেসরকারি তথ্য ও সেবাসমূহ জনগনের কাছাকাছি নিয়ে যেতে, প্রযুক্তি বিভেদ দূর করতে ও সকল নাগরিককে তথ্য প্রবাহের আধুনিক ব্যবস্থার সাথে যুক্ত করতে সুদুর প্রসারী ভূমিকা রাখতে পারে ।

‘জনগণের দোড়গোড়ায় সেবা’ (Service at Doorsteps)-এ ম্লোগানকে সামনে রেখে ইউআইএসসির যাত্রা শুরু হয়েছিল। ইউআইএসসি প্রতিষ্ঠার ফলে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতিটি ক্ষেত্রে একটি অবাধ তথ্য প্রবাহ সৃষ্টি করা সম্ভবপর হয়েছে, যেখানে মানুষকে আর সেবার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে না, বরং সেবাই পৌঁছে যাচ্ছে মানুষের দোরগোড়ায়। অবাধ তথ্য প্রবাহ জনগনের ক্ষমতায়নের অন্যতম পূর্বশর্ত।

ইউনিয়ন পরিষদে তথ্য ও সেবাকেন্দ্র স্থাপনের ফলে সাধারন নাগরিকগণ এখন সহজে, কম খরচে ও ঝামেলাহীনভাবে প্রায় ৬০ ধরনের সরকারি-বেসরকারি সেবা ইউআইএসসি থেকে পাচ্ছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১১ কোটি সেবা প্রদান করা হয়েছে, এবং সেবা প্রদান করে ইউআইএসসি উদ্যোক্তারা মাসে সাড়ে ৫ কোটি টাকা আয় করছেন।

ইউআইএসসি'র উল্লেখযোগ্য সরকারি সেবাসমূহ হলো: জমির পর্চা, জীবন বীমা, পল্লী বিদ্যুতের বিল পরিশোধ, সরকারি ফরম, পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল, অনলাইনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, অনলাইন জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, ভিজিএফ-ভিজিডি তালিকা, নাগরিক সনদ, নাগরিক আবেদন, কৃষি তথ্য, স্বাস্থ্য পরামর্শ প্রভৃতি। বেসরকারি সেবাসমূহ হলো: মোবাইল ব্যাংকিং, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, ছবি তোলা, ইন্টারনেট ব্রাউজিং, ইমেইল, চাকুরির তথ্য, কম্পোজ, ব্রিটিশ কাউন্সিলের ইংরেজী শিক্ষা, ভিসা আবেদন ও ট্র্যাকিং, ভিডিওতে কনফারেন্সিং, প্রিন্টিং, স্ক্যানিং, ফটোকপি, লেমিনেটিং প্রভৃতি।

কিছু উল্লেখযোগ্য সেবার চিত্র নিম্নরূপ:

  • কম্পিউটার প্রশিক্ষণ প্রদান ইউআইএসসি’র একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সেবা। একটি প্রযুক্তি নির্ভর সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে এ উদ্যোগ খুবই গুরুত্বপূর্ন। বর্তমানে ৩,৭৭৩টি ইউআইএসসি মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ব্যবহার করে স্বল্পমূল্যে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। ২০১০ সালের নভেম্বর থেকে মার্চ ২০১৪ পর্যন্ত প্রায় ৫২ হাজার ছাত্র-যুবক ইউআইএসসি থেকে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ পেয়েছেন।
  • গ্রামের মানুষের কাছে বীমা সুবিধা পৌঁছানোর লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় বীমা প্রতিষ্ঠান, জীবন বীমা কর্পোরেশন দেশের ২,৭৬৮টি ইউআইএসসি’তে জীবন বীমা সেবা চালু করেছে। এ পর্যন্ত মোট ৩৬ হাজার নাগরিক সেবা গ্রহণ করেছেন।
  • ব্যাংকিং সুবিধা বঞ্চিত তৃণমুল মানুষের কাছে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে ৪টি ব্যাংক (ডাচ বাংলা, ট্রাস্ট, ওয়ান ব্যাংক ও বিকাশ) দেশের ২৩৬৩টি ইউআইএসসি’তে মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৬০ হাজার নাগরিক সেবা গ্রহণ করেছেন।
  • জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিতে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) এ পর্যন্ত ৭২৭টি ইউআইএসসি'র মাধ্যমে পল্লী বিদ্যুতের বিল প্রদানের ব্যবস্থা করেছে।
  • গ্রামীণ জনপদের স্বাস্থ্য সুবিধা বঞ্চিত মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্য সুবিধা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহায়তায় বর্তমানে ৩০টি ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্র থেকে টেলিমেডিসিন চালু করা হয়েছে। এছাড়া প্রায় ৫০০টিরও বেশি ইউআইএসসি’তে স্বাস্থ্য ক্যাম্প চালু রয়েছে।
     

 

একজন দরিদ্র কৃষক ইউআইএসসি থেকে সঠিক সময়ে সঠিক তথ্য পাওয়ার মধ্যে দিয়ে ক্ষমতায়িত হচ্ছে; এতে তার কৃষি উৎপাদন এবং উপার্জন-দুটোই বাড়ছে। একজন সাধারণ নাগরিক উপজেলা বা জেলা অফিসে না গিয়েও জমির পর্চার নকলের জন্য আবেদন করতে পারছেন, যা তার সময়, শ্রম ও অর্থের সাশ্রয় ঘটাচ্ছে। একজন গ্রামের শিক্ষার্থী তার নিজ গ্রামে বসেই এসএমএস’র মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির জন্য আবেদন করতে পারছেন। একজন অভিবাসী শ্রমিক ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে ইংরেজী শিখতে পারছেন। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসেও একজন সাধারন মানুষ ভিডিও কনফারেন্স’র মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা নিতে পারছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষ মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই স্থানীয় দূর্যোগ পূর্বাভাস জানতে পারছেন। এভাবে ইউআইএসসি গ্রামীন মানুষকে বিভিন্ন সরকারি তথ্য প্রদানের মাধ্যমে ইউনিয়ন পরিষদকে ‘কার্যকর ও জনগনের প্রতিষ্ঠান’-এ পরিণত করেছে।

আর ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্রকে কার্যকর করে তুলেছেন ইউআইএসসি উদ্যোক্তা। প্রতিটি কেন্দ্রে দু'জন করে উদ্যোক্তা কাজ করেন; একজন ছেলে ও একজন মেয়ে। একজন নারী উদ্যোক্তা থাকার ফলে কেন্দ্রে নারীদের সহজে প্রবেশগম্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে। উদ্যোক্তা একজন বিনিয়োগকারী, চাকুরীজীবি নয় এবং জনগণকে সেবা প্রদানের মাধ্যমে অর্জিত আয় থেকেই উদ্যোক্তা তার জীবিকা নির্বাহ করেন। অর্থাৎ ৪,৫৪৭টি কেন্দ্রে মোট ৯,০৯৪ জন তরুন আইসিটি উদ্যোক্তার আত্ম-কর্মসংস্থান হয়েছে। যেহেতু তথ্য ও সেবাকেন্দ্র পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশীপ মডেলে পরিচালিত, সেহেতু সরকারের পাশাপাশি উদ্যোক্তাগণও বিনিয়োগ করেছেন। ইতোমধ্যে বেশ কিছু উদ্যোক্তা চরম প্রতিকূল অবস্থা অতিক্রম করে ভাল কাজ করছেন, এবং নাগরিকদের বিভিন্ন ধরনের সরকারি-বেসরকারি ই-সেবা প্রদানের মাধ্যমে মাসে ৫০ হাজার টাকার বেশি আয় করছেন। যশোরের আরবপুর ইউআইএসসি'র উদ্যোক্তা আরিফ, ঝালকাঠীর পোনাবালিয়া ইউআইএসসি'র উদ্যোক্তা নাদিরা, নওগাঁ'র নিতপুর ইউআইএসসি'র উদ্যোক্তা জোসনা, রংপুরের সদ্যপুস্করনী ইউআইএসসি'র উদ্যোক্তা মুন এবং সিরাজগঞ্জের ভাঙ্গাবাড়ি ইউআইএসসি'র উদ্যোক্তা সাদ্দাম তাদের মধ্যে অন্যতম।

 

ইউনিয়ন পরিষদ দেশের প্রাচীনতম স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, যাকে শক্তিশালী ও কার্যকর সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে পরিনত করার জন্য অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থার পরিবর্তন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির ব্যাপার। এটি রাতারাতি একদিনেই সম্ভব নয়। ধীরে ধীরে প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই পরিবর্তনসমূহ করতে হয়। এক সময়ে মানুষ ইউনিয়ন পরিষদ খুব বেশি ব্যবহার করতো না। কেবলমাত্র গ্রাম্য সালিশ-বিচারের কাজে ইউনিয়ন পরিষদ মাঝে-মধ্যে ব্যবহৃত হতো। মানু্ষের ধারনাই ছিল, ইউনিয়ন পরিষদ নিয়মিত খোলা হয় না। ইউআইএসসি এই ধারনাকে পরিবর্তন করে দিয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদে বর্তমানে মানুষের প্রবেশগম্যতা বেড়েছে। ইউআইএসসি থেকে প্রতি মাসে ৪০ লক্ষাধিক মানুষ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ই-সেবা গ্রহন করছেন। ইউনিয়ন পরিষদে ইউআইএসসি স্থাপনের ফলে ইউনিয়ন পরিষদের সক্ষমতা বহুগুনে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা শক্তিশালী হয়েছে। ইউআইএসসি'র সফল অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে, দেশের ৩১৯টি পৌরসভায় 'পৌর তথ্য ও সেবাকেন্দ্র (পিআইএসসি)' ও ১১টি সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড পর্যায়ে ৪০৭টি 'নগর তথ্য ও সেবাকেন্দ্র (সিআইএসসি)' স্থাপন করা হয়েছে।

ইউআইএসসি’র কাজের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত স্থানীয় প্রশাসন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাগন উপজেলা ই-গভ: ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) জেলা ই-গভ: ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে তদারকিসহ ইউআইএসসি টেকসইকরনের কাজে সরাসরি সম্পৃক্ত। জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারগণ এ বিষয়ক সিদ্ধান্ত গ্রহন ও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। ক্যাবিনেট ডিভিশন ও স্থানীয় সরকার বিভাগ এ কাজের সমন্বয় করে থাকেন। এর ফলে ইউনিয়ন পরিষদের প্রতি বর্তমানে মানুষের আস্থা অনেক বেড়েছে।

ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ইউআইএসসি পরিচালনা কমিটির সভাপতি হিসেবে ইউআইএসসি’র কার্যক্রমসমূহ মনিটরিং করে থাকেন। আর এ কাজে নিবিড়ভাবে সহযোগীতা করেন ইউনিয়ন পরিষদ সচিব। জেলা তথ্য কর্মকর্তা ইউআইএসসি’র প্রচার-প্রচারনায় সম্ভবপর উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকেন।  ফলে ইউনিয়ন পরিষদ সাধারন মানুষ, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, সচিব ও সদস্যদের জন্য একটি প্রেস্টিজিয়াস প্রতিষ্ঠানে পরিনত হয়েছে।

পৃথিবীর অনেক দেশই পরীক্ষামূলকভাবে টেলিসেন্টার, ওয়ান-স্টপ-সার্ভিস এবং ইনফরমেশন সেন্টার চালু করেছে; কিন্তু এমন কোন দেশের কথা জানা নেই যারা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহকে একযোগে উদ্বুদ্ধ করে সারাদেশে তথ্যকেন্দ্র স্থাপন এবং কেন্দ্রসমূহকে গণমূখী করতে পেরেছে। ইউআইএসসি স্থাপনের মাধ্যমে জনগনের দোড়গোড়ায় সরকারি-বেসরকারি সেবা পৌঁছানো, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহকে শক্তিশালী করা, কর্মসংস্থান সৃষ্টির কাজ একসাথে হয়েছে। বাংলাদেশের বিদ্যমান বাস্তবতায় এটি ছিল অচিন্তনীয়, এবং বলতে বাঁধা নেই। এটি বিশ্ব বাস্তবতায়ও অকল্পনীয়।